বিজ্ঞাপন

এই মধ্যরাত, গাড়ির স্টিয়ারিং, বন্য চাঁদের শখ- এসব আমার নয়?

May 16, 2018 | 3:49 pm

– আচ্ছা মা, তোমার কখনো ইচ্ছে করে না সন্ধ্যেবেলা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা আর আঙ্গুলের ফাঁকে একটা সিগারেট ধরে দেশ সমাজ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে? ইচ্ছে করে না অফিস শেষে বন্ধুদের সাথে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে? বা ধরো কিছুই না, ইভনিং শিফট অফিস করে গুনগুন করতে করতে নির্জন রাস্তা দিয়ে নির্ভয়ে একলা বাসায় ফিরতে? কেউ কিছু বলবে না, বিরক্ত করবে না, প্রশ্ন করবে না, ভয় দেখাবে না এমন নির্ঝঞ্জাট চলার পথ পেতে?

বিজ্ঞাপন

মা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ কাটিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে উঠল, কতদিন ভেবেছি পাড়ার বখাটেগুলোর কথা। সবাই জানে ওরা খারাপ, অথচ ওদের সমান অধিকারটুকুও আমি কোনদিন পাইনি। প্রায়ই ভাবি, আমি কি ওদের চেয়েও খারাপ তাই আমাকে আটকে থাকতে হয়! আমি কি ওদের চেয়েও ক্ষতিকর তাই আমার জন্য বাইরের পৃথিবীটা বারণ!

এবার আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিতান্তই দুঃখবোধ থেকে মাকে ফোন করেছিলাম। মা’র সাথে আমার অনেক অমিল, মতপার্থক্য, বয়সের তারতম্য, আমার জীবনবোধ অসীম। তবু কি অকপটে মা তার লুকনো ইচ্ছেগুলো মেলে ধরল, এত অনায়াসে মা একটা সমাজের নগ্ন ছবি দেখিয়ে দিল! এই তো ক’দিন আগে দেখলাম আমার সমবয়সী এক মেয়ে তার ইচ্ছের কথা বলেছে। এক হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, এক হাতে সিগারেট নিয়ে পাহাড়ে গাড়ি চালানোর তার বড় শখ। সে কখনো সিগারেট খায়নি, গাড়িও চালায়নি। তবু শখ তো, মানুষের তো কতই শখ থাকে।

আরেকজন প্রতিষ্ঠিত নারীকে দেখলাম। ভীষণ দুঃখ আর অভিমান নিয়ে লিখেছেন, মাঝরাতে তার একলা রাস্তায় চুপচাপ হেঁটে যাবার শখ। মধ্যরাত্রি, কাক-পক্ষীও যখন এই শহরে জেগে নেই, রিকশার টুংটাং, বড় বড় বাসের হাইড্রোলিক হর্ণ, ট্রাকের গগনবিদারী গর্জন, মানুষের হাঁটার ছপছপ শব্দ কিচ্ছুটি নেই; তখন কিন্তু নিশাচর ছাড়াও কিছু মানুষ এ রাস্তায় ও রাস্তায় থাকে। কেউ রাত দেখে, কবিতা লেখে, পতিতালয় থেকে ফেরে, কেউ অফিস শেষে কাল সকালের সংবাদের ডেস্কটপ ভার্সন রেডি করে ঘরে ফেরে, কারো ঘুম আসে না বলে অকারণ পায়চারি করে। তাহলে  এটা কি করে শখ হয়?

বিজ্ঞাপন

একজন নাগরিক যে কোন সময় রাস্তায় বের হবেন, প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে তাতে শখের কি আছে! এমন তো না যে, এভারেস্টের রাস্তা বা পাপুয়া নিউ গিনির জঙ্গল বা মহেশখালীর দস্যুপ্রবন দ্বীপে রোমাঞ্চকর ভ্রমণের মতো অনিশ্চিত এই শখ! কেবলই একটা রাস্তায়, জ্বী ঠিকই শুনেছেন একটা রাস্তায় নির্ভয়ে একলা হাঁটা। এটা কেবলই শখ নয়, স্বপ্নও বটে। এমন অনেক নারী রয়েছেন (বেশিরভাগ বলার চেয়ে সকল নারীও বলা যেতে পারে) যারা আজীবন এই এটুকু শখ পূরণ করতে পারেন না। যার কথা বলছিলাম তিনি সমাজের প্রতিষ্ঠিত সম্মানিত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন নারী। না কিশোরী, না কেবল গৃহবধূ। বয়স ও সম্মান দু’টোই তার আছে, অথচ নারী হবার কারণেই এই শহরে (দেশ বললেও ভুল হবে না) একলা হাঁটা, একটু দাঁড়ানো, দেবদারু গাছের ফাঁক গলে আসা চাঁদের আলোয় মাখামাখির স্বপ্ন কখনো বাস্তব হয়ে ওঠে না।

মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা, দৈহিক নিরাপত্তা দিতেই গঠিত হয়েছে দেশ, তৈরি হয়েছে আইন, নিশ্চিত করা হয়েছে শাসন। অথচ এক শ্রেণির নাগরিকের জন্য এখনো কোন দেশ, কোন আইন, কোন শাসন নিরাপত্তা দিতে পারে না। তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে যাদের বিবেচনা করা হয়, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে যারা সমাজে পরিচিত এই একটা ক্ষেত্রে তারাও কত স্বাধীন, কত নিরাপদ, কত নির্ভয়। অথচ সমাজে পুরুষের সমান অবদান, পুরুষের সমান যোগ্যতা, পুরুষের সমান মেধা নিয়েও এই সমাজে, এই রাষ্ট্রে নারী কত অনিরাপদ, কত নাজুক, কত স্বাধীনতা বিবর্জিত। পুরুষই প্রথম শ্রেণির নাগরিক, প্রথম লিঙ্গের অধিকারী আর নারী সম্পূরক, বিকল্প! এই বিকল্পের জন্য তাই সমাজ-রাষ্ট্রের মাথা না ঘামালেও চলে।

তারপর কোন নারী রাস্তায় নিগৃহীত হলে, হয়রানির শিকার হলে, গলা উঁচু করে প্রতিবাদ করলে সব দোষ নারীর। কেবল একজন নারী হবার কারণেই গণপরিবহনে, জন সমাগমে ‘মেয়ে হয়ে এত কথা বলেন কেন’ শুনতে হয়। যেন একটি নারীর গলার স্বর, প্রতিবাদ, নিজের শরীর, মস্তক এই সমাজের কাছে বিকিয়ে দেওয়ার নিয়ম, আজীবন বন্ধক রাখার নিয়ম! তাৎক্ষণিক তাই হয়রানির প্রতিবাদ করে, কেঁদেকেটে বিচার চাইতে গেলেও শুনতে হয় নারী হবার খোঁটা। নারী হলে এইসব নিগ্রহ, হয়রানি, চোখের জলই যেন নিয়তি। প্রতিকার চাইতে গেলে উপদেশ জোটে, ঘরে থাকার। বিচার চাইতে গেলে রায় হয়, সঙ্গী রেখে, বেশি রাত করে বাইরে না থাকার। প্রতিরোধে গলা তুলে কথা বলতে গেলে কানে ভীড় করে চারিত্রিক স্খলন, অশালীন কাপড়-চোপড় আর দৈহিক গঠনের ফিরিস্তি। যেন এই রাস্তাঘাট, শহর-বন্দর, বাস-ট্রেন নারীর জন্য নির্মিত হয়নি। প্রথম লিঙ্গের অপরিসীম দয়ায় ঠাঁই পেয়েছে তারা।

বিজ্ঞাপন

এই শখ, এই মধ্যরাত্রি, এই পথঘাট, এই চায়ের কাপ, গাড়ির স্টিয়ারিং, সিগারেটের ছাই, বন্য চাঁদ কিছুই নারীর নয়। কোনদিন আমার মায়ের অধিকারে আসেনি, আমার অধিকারেও আসেনি। একটা জীবন শুধু ভয়ে-উৎকণ্ঠায়ই কেটে যায়। ভয় দেখায় পথ-ঘাট, ভয় দেখায় গাছ-পালা, ভয় দেখায় বাসের কন্ডাক্টর, ভয় দেখায় প্রেমিক, ভয় দেখায় সমাজ, ভয় দেখায় পুরুষ, ভয় দেখায় অন্যান্য নারী। এই ভয়ের অধ্যায় শেষ হলে আরেক জনমে কি সব শখ মিটে যাবে? এই মধ্যরাত্রি, এই চায়ের কাপ, গাড়ির স্টিয়ারিং, সিগারেটের ছাই, বন্য চাঁদকে নিবিড় করে পাওয়ার শখ!

 

 

[রোকেয়া সরণি কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মত]

বিজ্ঞাপন

 

সারাবাংলা/এসএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন