বিজ্ঞাপন

মহাকাশেও হ্যাকিং, কতটা নিরাপদ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

May 24, 2018 | 6:04 pm

। নিজস্ব প্রতিবেদক।

বিজ্ঞাপন

প্রায় এক যুগ আগের কথা। ২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর হঠাৎ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায় ভারতের কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের। এর মধ্যে ছিল দেশটির অন্যতম বৃহত্তম মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ‘স্টার ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের’ কয়েকটি চ্যানেল।  চারপাশে হইচই-শোরগোল। সেবার মোট ১২ দিন বন্ধ ছিল স্টার ইন্ডিয়ার চ্যানেলগুলো। ওই সময় শোনা যায়, সিঙ্গাপুরভিত্তিক যে যোগাযোগ উপগ্রহ থেকে সেবা নিত মিডিয়া প্রতিষ্ঠানটি সেটির ট্রান্সমিশন হ্যাক হয়েছে।  তবে স্টার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ কখনোই স্বীকার করেনি ট্রান্সমিশন হ্যাকের খবর।  জানিয়েছিল, কারিগরি ত্রুটির কারণে এই সম্প্রচার বিপত্তি!

ভারতের জনপ্রিয়তম টেলিভিশন চ্যানেলের উদাহরণ এইজন্যই টানা কারণ ওই সময়ে হিন্দি চ্যানেল আসক্ত আমাদের দেশের অনেকেই বিষয়টি জানতেন। এছাড়া স্টার ইন্ডিয়ার আগে পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্যাটেলাইটের ট্রান্সমিশন হ্যাকের বিষয়টি আমাদের গণমাধ্যমেও বেশ আলোচিত হয়েছিল।  তবে এটা ঠিক যে এই ‘স্যাটেলাইট হ্যাকের’ বিষয়টি নতুন কিছু নয়।  বছর পনেরর কিশোর মার্কিন জাতীয় মহাকাশ সংস্থার (নাসা) উপগ্রহের ট্রান্সমিশন হ্যাক করেছে এমন উদাহরণও আছে। এছাড়া বৈশ্বিক গণমাধ্যম ঘেঁটে দেখা গেছে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, নরওয়ে, কানাডা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের উপগ্রহের ট্রান্সমিশন হ্যাকের ঘটনা ঘটেছে।

সম্প্রতি মহাকাশে গেছে আমাদের স্বপ্নের কৃত্তিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু-১’। এরই মধ্যে সফলভাবে কাজও শুরু করে দিয়েছে উপগ্রহটি।  ভূ-পৃষ্ঠের গ্রাউন্ডস্টেশন থেকে আমাদের ‘বঙ্গবন্ধু-১’এর মধ্যে দূরত্ব ৩৬ হাজার ৫০০ কিলোমিটার।  এখনই ভাববার সময় এসেছে যোগাযোগ ব্যবস্থার এই মধ্যবর্তী দূরত্বটি, এই সাইবার স্পেস কতখানি নিরাপদ?

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সাইবার স্পেসের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ প্রকল্পের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেষ্ঠ্য প্রযুক্তিবিদ সারাবাংলাকে জানান, কোন সাইবার হামলাকারী গ্রাউন্ডস্টেশন থেকে মহাকাশে পাঠানো টেলিমেট্রি (টেএম) অথবা টেলিকমান্ড (টিসি) সিগনালটি রিসিভ করে সেটিকে মডিফাই (বিবর্ধিত) করে স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যঘাত ঘটাতে অন্য কোন সিগনাল যুক্ত করে পাঠায় তাহলে সেটিকে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিশন হ্যাক বলা হয়।  আর এই বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ সচেতন বলেও জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিবিদ জানান, সাধারণত স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ডস্টেশন দুই প্রকারের।  এসওসিসি ও এনওসিসি। এসওসিসি হচ্ছে স্যাটেলাইট অপরেশন কন্ট্রোল সেন্টার। এসওসিসির মাধ্যমে ভূমি থেকে স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ করাসহ সেটির নানাবিধ পরীক্ষা করা হয়। এসওসিসিতে সাইবার হামলা হওয়ার সংখ্যা নেই বললেই চলে। কেননা এই ইন্টারফেসটি সম্পূর্ণ একটি অফলাইন সার্ভার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।  সাধারণত যে ব্যবস্থাটি আক্রান্ত হয় সেটি হল নেটওয়ার্ক অপারেটিং সিস্টেম বা এনওসিসি। এর মাধ্যমে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য জমা রাখা হয়। এটি সম্পূর্ণ ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত বলেই কোন দক্ষ সাইবার হামলাকারী কোনভাবে সিস্টেম হ্যাক করে এর সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

স্যাটেলাইট ট্রান্সমিশন হ্যাকের বিষয়ে কিছুদিন আগে সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ‘আইওঅ্যাকটিভ’ এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।  এতে জানানো হয়, স্যাটেলাইট যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদে নেই। যে কোনো সময় হ্যাকিং হতে পারে বিশ্বের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এসব প্রতিষ্ঠান। নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্রুটি দূর করার জন্য অতিদ্রুত ওই স্যাটেলাইট যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবকাঠামোসহ অন্যান্য ক্রুটি দূর করার পরামর্শও দেয় আইওঅ্যাকটি। না হলে স্যাটেলাইট যোগাযোগ পদ্ধতি বড় ধরণের হ্যাকিংয়ের হামলার শিকার হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।

‘আইওঅ্যাকটিভ’ এর প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে সাইবার হামলা করা হলে তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম নয় বর্তমান স্যাটেলাইট যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলো।  আইওঅ্যাকটিভ জানায়, মূলত নিরাপত্তার ক্রটির কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলো সাইবার হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে। জাহাজ, শিল্প, সামরিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত স্যাটেলাইটগুলোর দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হুমকির মুখে রয়েছে। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, হ্যাকাররা নানা কৌশলে বিভিন্ন ভাইরাসসমৃদ্ধ সফটওয়্যার স্যাটেলাইট যোগাযোগ সিস্টেমে প্রবেশ করিয়ে সর্ম্পূণভাবে সিস্টেমটি বন্ধ করে দিতে পারে। অনেক সময় এর মাধ্যমে সাইটটির পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হ্যাকারদের হাতে। এতে আরও জানানো হয়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘ইনমারসাট’ এবং ‘ইরিডিয়াম স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক’ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান দুটির মহাকাশ স্টেশনে নিরাপত্তায় ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে। এছাড়া ‘হার্টব্লিড বাগ’  ইন্টারনেট ভাইরাসের আক্রমণে স্যাটেলাইট যোগাযোগ সিস্টেমের নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বেশি বেড়ে গেছে বলে জানানো হয় গবেষকদের পক্ষ থেকে।

সাম্প্রতিক সময়ে এসে স্যাটেলাইটে সাইবার হামলা অনেক বেশি বেড়ে গেছে বলেও জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণেই বোধহয় হ্যাকিংমুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের প্রথম কোয়ান্টাম স্যাটেলাইট ‘মিসিয়াস’ উৎক্ষেপণ করেছে চীন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে চীনের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ গানশুর জিউকিউয়ান স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

চীনা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয় এ স্যাটেলাইটটি হ্যাকিং করা যায় না এমন উচ্চনিরাপত্তা সংবলিত ‘কোয়ান্টাম ফোটন’ প্রযুক্তিতে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে তথ্য পাঠাবে। এ স্যাটেলাইটটি চীনের জিনজিয়াং-এর মুসলিম বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকা উরুমকির সঙ্গে বেইজিংয়ের নিরাপদ যোগাযোগ নিশ্চিত করবে।

মহাকাশে এই মূহুর্তে দুই হাজারের বেশি যোগাযোগ উপগ্রহ রয়েছে। কোটি কোটি ডলার খরচ করে এই স্যাটেলাইটগুলোর নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।  অনেকেই স্যাটেলাইটে ব্যবহার করছে নতুন প্রযুক্তি।

আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে নিরাপত্তার জন্য কি কি করা আছে জানতে চাইলে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ওই প্রযুক্তিবিদ জানান, বঙ্গবন্ধু-১ নির্মাণে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ফ্রান্সের।  নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেলিস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে প্রথম তিন বছর প্রতিষ্ঠানটিই সরাসরি উপগ্রহটির নিরাপত্তা দিচ্ছে।  ওই প্রযুক্তিবিদ আরো জানান, গত শনিবার ফ্রান্স থেকে ৭ জন স্যাটেলাইট বিশেষজ্ঞসহ সাইবার নিরাপত্তা কর্মী বাংলাদেশে এসেছে তারা বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছে। তারা স্যাটেলাইটের সকল বিষয়াদি নিয়ে নিরীক্ষা চালাচ্ছেন।

সারাবাংলাকে ওই প্রযুক্তিবিদ আরো বলেন, ফ্রান্স থেকে আসা স্যাটেলাইট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন বর্তমানে তারা ‘লঞ্জ এন্ড আর্লি অরবিট ফেইজ’ সংক্ষেপে (লিইও) কাজ শেষ করছেন।  ওই প্রযুক্তিবিদরা জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর থেকে এখনো পর্যন্ত ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। কোন প্রকার টেকনিক্যাল সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি বলেও জানিয়েছে ফ্রান্স থেকে আসা ৭ জনের দলটি।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্পের পরিচালক মো. মেজবাউজ্জামান সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, আগামী ৩ বছর (২০১৯,২০ ও ২১ সাল) স্যাটেলাইটটির দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পর্যন্ত ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের। উৎক্ষেপণের পর থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নির্মাতারাই এটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে।

মো. মেজবাউজ্জামান আরো বলেন, ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস আগামী তিন বছর স্যাটেলাইটটির দেখাশোনার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিবেন। তিন বছর পর যখন চুক্তি অনুযায়ী  থ্যালেস এই দায়িত্ব ছেড়ে দেবে তখন বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত দলটি আরো বেশি দক্ষ হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এ সময় তিনি জানান, আগামী সপ্তাহে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস থেকে আরো ৪ জন কর্মীর বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।

মো. মেজবাউজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, যতদিন পর্যন্ত থ্যালেস এর দায়িত্বে রয়েছে ততদিন পর্যন্ত সাইবার হামলার কথা ভাবছি না। তবে এটা সত্য যে স্যাটেলাইটেরও নিরাপত্তা সংকট রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, হয়তো থ্যালেস এটির দায়িত্ব ছাড়ার পর বাংলাদেশ সরকার স্যাটেলাইটের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ভাববে এবং বিশেষ একটি দল গঠন করারো প্রস্তুতি রয়েছে।

গত ১১ মে রাত ২টা ১৪ মিনিটে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে প্রথম স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। দেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে নতুন যুগে ঢোকে বাংলাদেশ। কক্ষপথের উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু-১ বাংলাদেশের প্রথম জিওস্টেশনারি কৃত্রিম উপগ্রহ এবং ব্যবহারের ভিত্তিতে এটি যোগাযোগ স্থাপনকারী কৃত্রিম উপগ্রহ।

সারাবাংলা/এসও/ এসবি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন