বিজ্ঞাপন

ময়নার ঘোণা পাহাড়ে একা একজন আবুল কালাম

May 27, 2018 | 9:05 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার থেকে ফিরে: সাত বছর আগে গৌজঘোণা এলাকা থেকে পরিবারের সঙ্গে রাগ করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন ৩৮ বছরের আবুল কালাম। কোথায় যাবেন-জানা ছিল না। মূল রাস্তা দিয়ে যখন যাচ্ছিলেন তখন পাশেই ছিল ময়নার ঘোণা পাহাড়।

স্থানীয়রা পাহাড় বললেও সেটি ছিল আসলে টিলা- আঞ্চলিক ভাষায় ‘ছোড পাহাড়।’ সেখানেই আশ্রয় নেন তিনি। স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে নিয়ে একদিনের মধ্যেই সেখানে বাঁশ আর বেড়া দিয়ে ঘর তোলেন ।তারপর ধীরে ধীরে বাঁশের ঘরের বদলে তৈরি করেন মাটির ঘর। ঘরের পাশেই তৈরি করেন গোয়াল ঘর, মুরগী আর হাঁসের জন্য তোলেন কাঠের ঘর।

পাহাড় থেকে আগাছা সাফ করে আশেপাশের পরিত্যক্ত জমিতে ঘাম ঝড়িয়ে কোঁদাল চালান তিনি, সঙ্গে হাত মিলিয়ে পরিত্যক্ত জমিকে বসবাস আর গাছ লাগানোর উপযোগী করে তোলে পুরো পরিবারটি।

বিজ্ঞাপন

একটিমাত্র মাটির ঘরের সঙ্গে পরে যোগ হয় আরও অনেক কিছু। আশেপাশের জমিতে শশা-ডাল-হলুদ-কলা-মরিচ-সুপারি-পেয়ারা-নারকেল-লিচুর বাগান করেছিলেন, করেছিলেন পানের বরজও। ঘর লাগোয়া গোয়াল ঘরে ছিল সাত থেকে আটটি গরু, ছিল প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি হাঁস। মশলা ক্ষেত ছাড়াও লাগিয়েছিলেন প্রায় ৪ শ রকমের বনজ গাছ, সেগুলো দীর্ঘদেহী কালামের কাঁধ ছাড়িয়ে মাথা ছুঁই ছুঁই করছিল।

রীতিমতো নিজের করে ময়নার ঘোণা পাহাড়কে সাজিয়ে নিয়েছিলেন আবুল কালাম, কিছুদিন পর সঙ্গে নিয়ে আসেন ছোট বোনকেও।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু ময়নার ঘোণা পাহাড়ে কেবল এখন আবুল কালামের থাকার ঘরটি ছাড়া আর কিছুই নেই। পাশেই রয়েছে শূণ্য গোয়াল, হাঁসের ঘরটির মুখ খোলা। নিজের হাতে লাগানো একটি গাছও নেই, নেই মশলা ক্ষেতও। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালি-কুতুপালং ক্যাম্প এখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় শরনার্থী শিবির হিসেবে পরিচিত। সেই বালুখালির একটি পাহাড় ময়না ঘোণা। ক্যাম্পে যাবার আগেই জানা যায়, ক্যাম্পে একটা স্থানীয় পরিবার আছে-তাদের চারিদিকে কেবল রোহিঙ্গা শরনার্থী। সব হারিয়ে পরিবারটি সেখানে কোনও রকমে বেঁচে আছে।

সেই স্থানীয় পরিবারটি দেখতে ময়নার ঘোণার চূড়ায় যাওয়া। গিয়ে দেখা যায়, ঘরের ভেতরে মাটির প্রলেপের কাজ করছেন সবাই মিলে। একসময় তাদের ফুসরত মিললে কথা হয় আবুল কালাম ও তার স্ত্রী জরিনা বেগমের সঙ্গে। আবুল কালাম বলেন, আয় উপার্জন এখন কিচ্ছু নাই-না খাইয়া মরবো বুঝি।

তিনি বলেন, ওদের ( রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী) কারনে সব শেষ হইছে। ক্ষেত ক্ষামার সব চলে গেছে, দিন মজুরীর কাজ করতাম-সেসব কাজও রোহিঙ্গাদের দখলে। কেবল মাত্র রাতের বেলায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করে ১০ হাজার টাকা পাচ্ছেন। এই টাকা দিয়েই চলছে তার সংসার। আবুল কালামের ভাষায়-এ টাকাই বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়ে গিয়েছে তিন সন্তানের লেখাপড়া।

বিজ্ঞাপন

চেয়ারে বসে কপাল হাত ঠেকিয়ে তিনি বলেন, দুইটা গরু মরে গেছে-ঘাস পায়না, খাওন দিতে পারি না, তাইলে বাঁচবো ক্যামনে। আর এখন তরমুজের বাকল, খড়, পঁচা গরু খাইয়া একটা মাত্র গরু কোনওরকমে বাঁইচে আছে। এসময় পাশ থেকে জরিনা বেগম বলেন, ১৪টা বাচ্চাসহ একটা মা হাঁস মইরা গেল-খাইতে না পাইয়া। ঝিঙ্গা ক্ষেত, পানের বরোজ, কাঁচা হলুদ সব গেছে ওদের জায়গা দিতে গিয়া। দুইটা ছাগল খেতে পারতেছিল না, সস্তা দামে তাই বেঁইচা দিছি।

আবুল কালামের বোন সাবেকুন্নাহার বলেন, তার স্বামী নাসিরুদ্দিন অসুস্থ, চট্রগ্রামে রিকসা চালায়। কিন্তু মাসের দিন সুস্থ থাকেতো বাকী দিনগুলোতে বাড়ি এসে থাকতে হয়। তিন ছেলেকে নিয়ে তাদের সংসার, কিন্তু এখন সেই সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

অথচ আগে ক্ষেত থেকে শশা, হলুদ, মরিচ বিক্রি করেই চলতো তাদের সংসার। পিএসসি পরীক্ষা দেবার পর ছেলে ইমনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে, টাকার অভাবে। দিন আনতেই দিন ফুরায় এখন-বলেন সাবেকুন্নাহার।
আবুল কালাম বলেন, স্থানীয় ভাবে চাকরি সুযোগ তৈরি হলেও সবাই রোহিঙ্গাদের প্রাধান্য দেয়-স্থানীয়দের কথা কেউ ভাবছে না, আমরাই এখন আমাদের দেশে সংখ্যালঘু হয়ে গেছি বলেন তিনি।

তিনি বলেন, আমার জায়গাতে ওরা স্কুল করেছে, কিন্তু সেখানে আমাদের ছেলেমেয়েদের যাবার সুযোগ নেই-ওদের স্কুলেও যেতে পারছে না আমার বাচ্চারা।

রোহিঙ্গারা আসার পর কিছুটা ত্রান আমরা পেলেও এখন সেসবও বন্ধ। আমরা কোনও রকমে বেঁচে আছি এখন-কেউ আমাদের কথা ভাবছে না। আমার বাড়ির চারপাশে ওরা-আমি এখন এখানে একা-কেউ নেই সাথে।

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন